জানার জন্যই জানতে চাই - মাইক বেকার

২০১১ সালে অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিভাগের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই বক্তব্য দেন মাইক বেকার। দীর্ঘদিন তিনি সাংবাদিকতা করেছেন বিবিসিতে, শিক্ষা বিষয়ে। ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: রুহিনা তাসকিন

আজ আপনাদের সঙ্গে থাকতে পেরে আমি খুব আনন্দিত। সবাইকে অভিনন্দন।

আমি গ্র্যাজুয়েট হয়েছি ৩২ বছর আগে, ১৯৭৯ সালে। মার্গারেট থ্যাচার তখন সবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, সনি ওয়াকম্যানকেই ধরা হতো শীর্ষ প্রযুক্তিপণ্য, গড়পড়তা বাড়ির দাম ছিল ১৩ হাজার পাউন্ড, মুদ্রাস্ফীতি ১৭ শতাংশ...আর আপনাদের বিশ্বাস হবে না, ফুটবল লিগে আমার প্রিয় দল ইপসউইচ টাউন ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চেয়েও দুই ধাপ আগে! সেটা একেবারেই একটা অন্যরকম দুনিয়া ছিল।

তখন ইংল্যান্ডের স্কুলগুলো জাতীয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে এ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে থ্যাচারের আমল থেকেই।

এর কিছু সময় পর থেকেই আমি শিক্ষা নিয়ে সাংবাদিকতা করতে শুরু করি।

আশির দশকের শেষে থ্যাচারই শুরু করেন জাতীয় পাঠ্যক্রম ও জাতীয় পরীক্ষার। এরই ধারাবাহিকতা চলছে এখনো।

তবে এখন আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষাক্ষেত্রকে স্বাধীনতা থেকে জবাবদিহির পর্যায়ে আনাটা অনেকটাই লাগামছাড়া হয়ে পড়েছে। পরীক্ষাগুলো সঠিক হচ্ছে না, তা বলছি না। কিন্তু এত ঘন ঘন পরীক্ষা নেওয়া আর এগুলোকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কারণে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারও ঘটছে।

ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় একসময় সবচেয়ে কম পরীক্ষা নেওয়া হতো। মাত্র কয়েক দশকেই এখন তা হয়ে গেছে অনেক বেশি। বেশির ভাগ স্কুলই শেখানোর বিষয়টাকে সঙ্কুচিত করে এনেছে। তারা জোর দিচ্ছে শুধু পরীক্ষার সিলেবাসের ওপর।

আমি ভাগ্যবান যে সিলেবাসের বাইরে অনেক কিছুই আমাদের শেখানো হতো। আর সে বিষয়গুলোই আমার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে।

যেমন, আমাদের ইংরেজি শিক্ষকের মনে হয়েছিল ও লেভেলে ইংরেজি সিলেবাসটা খুবই ছোট। তাই তিনি আমাদের নিজস্ব সিলেবাস তৈরি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। আর তখনই আমি আবিষ্কার করি জর্জ অরওয়েলের সাহিত্য, যা পরে আমার সাংবাদিক জীবনের বীজ বুনে দিয়েছিল।

বলা যায়, সেই প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকের কথা, যিনি স্কুলে দুপুরের খাবারের সময়ে টেলিভিশনে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে দিয়েছিলেন; যা আমাকে সারাজীবনের জন্য ক্রিকেটে আগ্রহী করে তুলেছে।

এসব কথা বললাম, বড় পরিসরে শিক্ষার বিষয়টি বলার জন্য। পরীক্ষার তারিখে চোখ না রেখে, ক্যারিয়ার বা শিক্ষায় পরের ধাপ পার হওয়ার বাধ্যবাধকতায় না থেকে শুধু শেখার বিষয়টি ভাবার জন্য।

তবে এটাও গুরুত্বপূর্ণ, শিশুরা যাতে সেসব শেখে, যাকে আমাদের রাজনীতিকেরা মনে করেন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অন্যান্য সব শিক্ষাকেও যেন আমরা সঙ্কুচিত না করি। শুধু শেখার আনন্দ পাওয়ার জন্য, নতুন কিছু জানার জন্যও যেন শিখি।

আর আমার এ ধারণা আরও শক্ত হয়েছে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পর।

ছয় মাস আগে আমার চতুর্থ পর্যায়ের ফুসফুস ক্যানসার ধরা পড়ে। আমি হতবাক হয়ে যাই। কারণ, আমি কখনোই ধূমপান করতাম না।

আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, একদম আগের মতোই জীবন যাপন করা। ক্যানসার আমাকে হারাতে পারবে না।

কিন্তু যখন কেমোথেরাপির প্রভাব পড়তে শুরু হলো, জীবন কতটা ছোট, তা আমি ভাবতে শুরু করলাম। আর তখন থেকেই আমার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যেতে লাগল।

আমি আমার কাজটা খুব উপভোগ করতাম।

কিন্তু এই সময়ে আমি উপলিব্ধ করলাম, কাজকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমি যেন অন্যান্য বিষয়ে খুব সাদামাটা থেকে গেছি।

সব সময় আমি ডেডলাইন ধরার জন্য ছুটতাম। ১০টার খবরে কীভাবে আমার রিপোর্ট ধরাব, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতাম।

কিন্তু এখন আমি কাজ আর জীবনের ভারসাম্য চাই। আর শুধু আনন্দ পাওয়ার জন্যই ছোটখাটো কিছু বিষয় শিখতে চাই।

যেমন, আমার আশপাশের গাছগুলো নিয়ে আমি জানতে চাই। এখন তাই আমি হাঁটতে যাই গাছ চেনে এমন একজনকে সঙ্গে নিয়ে। আর কাঠের কাজ শেখার ক্লাসেও ভর্তি হয়ে গেছি।

এই তালিকাটা বেশ লম্বা, সেটা শুনিয়ে আপনাদের আর বিরক্ত করতে চাই না।

কিন্তু এর মধ্যে একটা জিনিস আছে—সেটা হলো, শেখার আগ্রহ। পেশাজীবনে ভালো করা বা উপার্জনের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা থেকে নয়, শুধু জানার জন্যই জানতে চাই।

আর এখন এটাই আমার উপলব্ধি, ডেডলাইন ধরার তাড়ায় যা কিছু আমি আগে এড়িয়ে গেছি, তা এখন শিখতে চাই।

আপনারা শিক্ষক হতে যাচ্ছেন, শুধু গ্রেড আর পাস নম্বরেই মনোযোগ দেওয়ার জন্য চাপ আসবে আপনাদের ওপর। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান।

মনে রাখবেন, এসব বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর বাইরে অনেক বিছু শেখানোর আছে। যার প্রভাবে হয়তো আপনাদের জীবনটাই বদলে যাবে।

শেখার আনন্দ শেখা, এটাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url